বিদেশফেরত বাংলাদেশিদের বড় অংশই পর্যবেক্ষণের বাইরে

বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের সিংহভাগই রয়ে গেছেন পর্যবেক্ষণের বাইরে। রকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, গত প্রায় দুই মাসে চীন-ইতালিসহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সাড়ে পাঁচ লাখের মতো বাংলাদেশি দেশে এসেছেন। তাদের বেশিরভাগই কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ঢাকায় বিমানবন্দর পার হয়ে গেছেন। প্রতিবেদন বিবিসি বাংলার।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দাবি, গত কয়েক সপ্তাহে বিদেশ থাকা আসা বাংলাদেশিদের মধ্যে দেশটির ২০টি জেলায় প্রায় দুইশো জনকে নিজ নিজ বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায় হোম কোয়ারিন্টিনে রাখা হয়েছে।

হোম কোয়ারিন্টিনে থাকা আর বিদেশ ফেরত বাংলাদেশিদের সংখ্যার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে দু’সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে আসা কয়েকজন বলেছেন, তারা দেশে আসার পর থেকে আত্নীয়স্বজনের সাথে থাকাসহ উন্মুক্ত পরিবেশেই রয়েছেন। কোনো পর্যবেক্ষণ না থাকায় তাদেরই অনেকের মাঝে এখন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

চীনের পর ইতালিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।ইতালি থেকে একজন প্রবাসী ঢাকায় আসেন ১২দিন আগে, গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি। তিনি ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই বেরিয়ে আসেন।

তিনি বিমানবন্দর থেকে সরাসরি শরিয়তপুর জেলায় তার গ্রামের বাড়িতে যান। এই প্রবাসী বলছিলেন, যদিও তিনি সুস্থ রয়েছেন, কিন্তু কোনো পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের মধ্যে না পড়ায় তার নিজের মাঝেই এক ধরণের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

“২৯শে ফেব্রুয়ারি রাত ২টায় আমি ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমেছি। এখানে আসার পর একটা ফরম দিছে। সেটা পূরণ করে জমা দেয়ার পর আর কিছুই আমাকে বলেনি। শুধু ইমিগ্রেশন যখন পার হই, তখন পাসপোর্ট দেখে বললো, আপনার কি পরীক্ষা হয়েছে? আমি বললাম না। তখন ইমিগ্রশনে বললো, পরীক্ষাটা হলে ভাল হতো। এই বললো। আর কিছুই না। তারপর পাসপোর্টে সিল মেরে দিলো। আমি এসে পড়লাম।”

তিনি আরও জানিয়েছেন, তিনি যে ফরমটা পূরণ করেছেন, তাতে কোন দেশ থেকে এসেছেন, সেই দেশের নাম এবং পাসপোর্ট নম্বর-এসব লিখতে হয়েছে।

এই প্রবাসী বাংলাদেশি বলছিলেন, ১২ দিন ধরে দেশে এসে তাকে কেউ পর্যবেক্ষণ করেনি বা সরকারের কোনো বিভাগ থেকে তাকে কোনো পরামর্শও দেয়া হয়নি।

তিনি বিদেশ থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলছেন কিনা, এই প্রশ্নে তিনি বলছিলেন, “এখন বাড়িতে আসছি, আত্নীয় স্বজন বা ভাইবোনরাতো আসবেই। তাদের কাছে না গিয়ে বা তাদের সাথে কথা না বলেতো পারি না। তবে পাবলিক অনুষ্ঠানে কম যাই।”

তিনি আরও বলেছেন, কোথাও কোনো বাধা আমি পাই নাই। আজকেই আমার গ্রামের এলাকার থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমাকে টেলিফোন করে নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলো। আর বললো যে, কতদিন হয়েছে দেশে এসেছেন। আমি বললাম ১২দিন হবে। তখন সেই পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, আরও দুই তিন দিন বাড়িতে থাইকেন। এটুকুই।”

গত ২১ জানুয়ারি থেকে বিমানবন্দর এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্ক্যানিং ব্যবস্থা করার পর থেকে এপর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি যাত্রীকে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারি হিসাবেই এই সময়ে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের বড় অংশ সেই পরীক্ষার বাইরে রয়ে গেছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইতালি থেকে দেশে এসে ঢাকার পাশের একটি জেলায় বাড়িতে নিজে থেকে কোয়রেন্টিনে থাকার চেষ্টা করেছেন একজন প্রবাসী। তিনি বলছিলেন, বাড়িতে থেকে পুরোপুরি কোয়ারেন্টিনে থাকা সম্ভব হয় না। তাকেউ বিমানবন্দরে পরীক্ষা করা হয়নি।

তিনি জানান, “বিমানবন্দরে পরীক্ষা করার মতো অবস্থা বলা চলে যে ছিল না। কয়েকটা ফ্লাইটের এক হাজারের মতো যাত্রী ছিল। সেখানে এত যাত্রীকে পরীক্ষা করার পর্যাপ্ত জায়গাই ছিল না। শুধু সতর্কতামূলক একটা লিফলেট হাতে ধরিয়ে দেয়। এটুকুই।”

“তারপরও আমি নিজ দায়িত্বে বাসায় এসে নিজের শংকা থেকে বাড়িতেই অবস্থান করি। সামাজিকভাবে কারও সাথে মেলা মেশা করি না। কোয়ারেন্টিন যেটা, সেটা পুরোপুরি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ পরিবারের সদস্যরা আছে। কিন্তু বাজারে যাওয়া বা বাড়ির বাইরে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া আমি এড়িয়ে চলছি।”

সরকারের পক্ষ থেকে দেশে আসা বাংলাদেশিদের নিজে থেকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরার্শ দেয়া হচ্ছে। সেটা কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

তবে রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছিলেন, “আমরা এটা কিছুটা সফটলি করছি। কারণ এমনিতেই দেশে অনেকের মধ্যে একটা আতংক বিরাজ করছে। তারপর যদি আমরা খুব হার্ড লাইনে যাই, তাহলে একটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।”

একইসাথে তিনি স্বীকার করেছেন যে, কিছু ব্যপ্তয় ঘটছে।

“কিছুটা জায়গায় কিছু ব্যাপ্তয় ঘটেছে। কিন্তু আগের তুলনায় পর্যায়ক্রমে এটা ইমপ্রুভ করেছে। কিন্তু যাদের মধ্যে লক্ষণীয় উপসর্গ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে কঠোরভাবেই আমরা আইস্যুলেশনে রেখে নমুনা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

এদিকে, বাংলাদেশে বিদেশ থেকে এসে যে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে দু’জন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে সরকার থেকে জানানো হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন